Thursday, 29 May 2025

চিকিৎসা নয়, অবহেলাই—বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর বাস্তব চিত্র


বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের ভিত্তি মূলত গঠিত হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর উপর। দেশের সাধারণ জনগণের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার প্রধান ভরসাই হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালের মান ও সেবার অবস্থা এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যা ন্যায়বিচার, মানবতা ও দায়িত্ববোধের পরিপন্থী। চিকিৎসা পাওয়ার আশায় যে মানুষগুলো হাসপাতালের দ্বারস্থ হন, তারা অনেক সময় ফিরে আসেন শুধু হতাশা আর যন্ত্রণার বোঝা নিয়ে।


প্রথমেই যদি রোগী ভর্তি প্রক্রিয়ার কথাই বলা হয়, তাহলে দেখা যায়, অধিকাংশ হাসপাতালে উপযুক্ত নির্দেশনা কিংবা তথ্য বোর্ডের অভাব রয়েছে। নতুন কোনো রোগী ভর্তি হতে এলে তাদের পরিবারকে ঘন্টার পর ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করতে হয় সঠিক বিভাগ বা কক্ষ খুঁজে পেতে। অনেক সময় চিকিৎসক বা নার্সদের অনুপস্থিতি কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণও রোগী ও স্বজনদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলে।


চিকিৎসা পদ্ধতিতে যে বিশৃঙ্খলা আছে, তা আরো পরিষ্কার হয় যখন দেখা যায়, চিকিৎসকের সংখ্যার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। একজন চিকিৎসককেই কখনো কখনো ৫০-৬০ জন রোগী দেখাতে হয় দিনে। এতে স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসার মানের উপর প্রভাব পড়ে। রোগী যথাযথভাবে নিজের সমস্যাটাও খুলে বলতে পারে না, আর ডাক্তারদেরও পর্যাপ্ত সময় থাকে না ঠিকমতো রোগ নির্ণয় বা পরামর্শ দেওয়ার।


এছাড়া বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালেই ওষুধের সংকট প্রকট। যদিও কাগজে-কলমে সরকারিভাবে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের কথা বলা হয়, বাস্তবে দেখা যায়, হাসপাতালের ফার্মেসিতে অধিকাংশ সময় ওষুধ থাকে না। ফলে রোগীর পরিবারকে বাইরে থেকে অনেক দাম দিয়ে ওষুধ কিনে আনতে হয়। যেসব দরিদ্র মানুষ সামর্থ্যের অভাবে সরকারি হাসপাতালমুখী হন, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এই ব্যবস্থায়।


স্বাস্থ্যকর্মীদের আচরণ নিয়েও বহু অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় নার্স বা ওয়ার্ডবয়দের ব্যবহার এতটাই দুর্ব্যবহারপূর্ণ হয় যে, রোগী ও তার স্বজনরা অপমানিত ও আতঙ্কিত বোধ করেন। কেউ কেউ টাকা ছাড়া ন্যূনতম সেবা দিতে অনাগ্রহী। এটি যেন একপ্রকার অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। দায়িত্ববোধ ও মানবতাবোধ যেন দিনকে দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানে।


হাসপাতালের পরিবেশের কথায় আসা যাক। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো অপরিচ্ছন্ন। শৌচাগারের অবস্থা এমন যে, ব্যবহার করার আগেই রোগী সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। ময়লার ঝুঁটি, নোংরা বিছানা, দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ – সবকিছু মিলিয়ে একজন রোগীর পক্ষে সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, বরং নতুন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।


যন্ত্রপাতি থাকলেও অনেক সময় তা নষ্ট থাকে মাসের পর মাস। কখনো কখনো কোনো টেকনিশিয়ান না থাকায় এক্স-রে বা আল্ট্রাসাউন্ড করা সম্ভব হয় না। আবার কখনো রিপোর্ট দেয়ার জন্য রোগীকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে।


আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, রোগী মৃত্যুর পরও অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিবারকে যথাযথ সহযোগিতা করে না। কখনো মরদেহ হস্তান্তরের সময় বিলম্ব হয়, কখনো আবার টাকা না দিলে কাঙ্খিত কাগজপত্র দেওয়া হয় না। এটি কেবল অমানবিকই নয়, আইনবিরুদ্ধও বটে।


তবে এই অন্ধকারের মাঝে কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা এখনো আশার আলো দেখায়। কিছু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন যারা আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, রোগীকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেন। তবে তারা সংখ্যায় কম এবং সিস্টেমের ভেতরে থেকে অসহায়। সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মীরাও মাঝে মাঝে এই অব্যবস্থার শিকার হয়ে যান।


সরকার প্রতিনিয়ত বাজেট বৃদ্ধি করছে স্বাস্থ্যখাতে, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবেই সেবার মান উন্নত হচ্ছে না। বরং নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্র নিয়ে খুব একটা সচেতন নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।


এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমেই দরকার একটি সৎ ও শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা। হাসপাতালে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়মিত মূল্যায়ন, সেবার মান যাচাই, অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ—এসব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে। সেই সঙ্গে রোগীদের অভিযোগ জানানো ও প্রতিকার পাওয়ার সহজ ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক।


এছাড়া চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ের কমিউনিটি মনিটরিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি দিয়ে গঠিত এই কমিটি নিরপেক্ষভাবে হাসপাতালের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে পারবে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠাতে পারবে।


স্বাস্থ্যখাত হলো দেশের মেরুদণ্ড। এখানে অবহেলা মানেই একটি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা। সময় এসেছে আমাদের সবাইকে এই দুরবস্থা নিয়ে চিন্তা করার, কথা বলার এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়ার। কারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার সবার, কিন্তু সেই সেবার মান যদি মানবতাবিরোধী হয়, তাহলে উন্নয়নের সকল কথাই শুধু মুখের বুলি হয়ে থাকে।


No comments:

Post a Comment